– বদরুল ইসলাম বাদল

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জর্জরিত কক্সবাজারবাসী অতি দ্রুত রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানোর জন্য কার্যকর ভূমিকা আশা করে সংশ্লিষ্টদের কাছে। দিন যতই যাচ্ছে বেপরোয়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কক্সবাজার বাসী মারাত্মক ঝুঁকিতে। মানবিক দিক এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনুরোধে মায়ানমার জান্তা সরকার কতৃক নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে।কিন্তু বার্মা সরকারের কূটচাল এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার উদাসীনতায় রোহিঙ্গারা তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দিনের পর দিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে । ফলে বর্তমান রোহিঙ্গাদের কার্যকলাপ নিয়ে চরম অনিরাপদ মনে করছে কক্সবাজারবাসী।যা বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা একটি অযাচিত চাপ।

স্বভাবগত ভাবে বাঙালী জাতি উদার এবং পরোপকারী মন। সমুদ্র পাড়ের কক্সবাজারের মানুষ খুবই অতিথিবৎসল ।মায়ানমার সরকারের অত্যাচারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হয়। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয়ে আসলেও কক্সবাজারবাসী এদের মেহমান হিসেবে বরণ করে। তাদের কষ্টে শুধু সমবেদনা জানিয়ে নয় কার্যত তাদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়ায়।রোহিঙ্গা শিশুদের কান্না, মহিলাদের সম্ভ্রম রক্ষা, এবং বয়স্কদের কষ্টের কথা চিন্তা করে কক্সবাজারের মানুষ যে যেভাবে পারে তাদের মানবিক সহযোগিতা করে। কেউ খাবার, কাপড়, ডেকসি কিংবা কেউ নিজের ভিটার এককোনায় কিংবা নিজেদের ফসলী জমিতে ও থাকার জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।রোহিঙ্গাদের কষ্ট নিজেদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়।2017 সালে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখতে আসা জাতিসংঘের শরনার্থী সংস্থা UNHCR এর শরনার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্তি বাংলাদেশ তথা কক্সবাজারের মানুষের রোহিঙ্গাদের প্রতি দরদ, ভালবাসা দেখে অবাক হয়ে যান এবং অত্যান্ত সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। শরনার্থী নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ দিনের কাজের অভিজ্ঞতা তার।তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মত প্রকাশ করে বলেছিলেন, “শরনার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ যে মমত্ববোধ দেখিয়েছে তা তিনি তাঁর কর্মজীবনে কখনো দেখেননি।”বলতে গেলে কক্সবাজারবাসীর মমত্ববোধের কথাই সবার আগে চলে আসে।

আধুনিক বিশ্বের বহু মানুষ চাকরি, বানিজ্য কিংবা পড়ালেখার সুবাদে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে অবস্থান করছে।তবে “একজন ব্যাক্তি যিনি নিজ ভূমি ছেড়ে যুদ্ধ, গনহত্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়াতে আশ্রয়ের সন্ধানে অন্য দেশে অস্থায়ী অবস্থান করে তাদের শরনার্থী বলা হয়ে থাকে”। অন্যদিকে উন্নত জীবন বা কর্মসংস্থানের খোঁজে স্থান পরিবর্তন করে অন্য দেশে অবস্থান করাকে অভিবাসী বলে মনে করা হয়। তাই বলা যেতে পারে যে, রোহিঙ্গারা কর্মসংস্থানের খোঁজে নয়, সাময়িক আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে আসে।নিজ দেশের শাসক শ্রেণির অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে আসে। কিন্তু বর্তমানে রোহিঙ্গাদের কার্যক্রম এবং অবাধ চলাফেরা দেখে মনে হয় না যে তারা শরনার্থী কিংবা আশ্রিতা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো যেনো মাদক ও অস্ত্রের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী অস্ত্র এবং মাদক উদ্ধার করে। অভিযোগ রয়েছে রোহিঙ্গারা সারাদেশে মাদক পাচারের সাথে জড়িত। মুক্তিপণ, হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ সহ চোরাচালান, নারী পাচার সহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত হয়ে আছে তারা।স্থানীয় জনগণ তাদের মেহমান হিসেবে সমাদরে গ্রহণ করে কিন্তু সেই রোহিঙ্গারাই স্থানীয়দের অপহরণ করছে,সন্তানদের টাকার জন্য জিম্মি করছে। হত্যা করছে, মারামারি করে চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে। শুধু তাই নয় কৌশলে জমি ক্রয় করে অনেক রোহিঙ্গারা স্থাপনা নির্মাণ করে।অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের অনেক দেশে পাড়ি জমায় এবং সেখানে ও বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে বাঙালীদের সন্মান ক্ষুন্ন করছে। সৌদিয়া আরবে প্রবাসী বাঙালিদের সাথে আলাপ করে জানা যায় যে,সৌদিয়াতে বাঙালী ভিসা অনেক দিন বন্ধ ছিল।রোহিঙ্গারা সেখানে অনেক দুস্কর্মে জড়িয়ে যায়। অনৈতিক অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। প্রতারণা চুরি ডাকাতি রাহাজানি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ করে। পুলিশের অভিযানে ধরাও পড়ে।যেহেতু তাদের হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট। তাই তাদের বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে বদনাম হয় বাঙালীদের। এমন সময় ছিল যে, যখন অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলে লুঙ্গী পড়া মানুষ দেখলে সৌদি পুলিশ বাঙালী মনে করে আর চেক করতো না। কারণ সৌদি প্রশাসনের কাছে বাঙালী ছিল কর্মট এবং শান্তি প্রিয় জাতি। তাই বাঙালীদের অন্য দেশের মানুষের থেকে ভালো নজরে দেখে।ফলে বাঙালীরা খুব কম তল্লাশির মুখোমুখি হতো।সে রকম অভিযানের সময় লুঙ্গী পরিধান করে অন্যদেশের বহু অবৈধ নাগরিক রক্ষা পেয়ে যেত।কিন্তু ধরা পড়া রোহিঙ্গাদের পরিচয় পত্র বাংলাদেশী হবার কারণে বাঙালী হিসেবে মনে করা হয়।ফলে বাঙালির প্রতি তাদের আগের বিশ্বাস চরম ভাবে লোপ পেয়ে যায়। তাতে বাঙালীদের প্রতি সৌদি প্রশাসনের মনোভাব পরিবর্তন হয়ে ঘৃনায় পরিণত হয়। ফলে বাঙালি ভিসা বন্ধ হওয়ার পিছনে অন্যান্য কারণের সাথে রোহিঙ্গাদের অপরাধ অন্যতম মনে করে অনেক প্রবাসী বাঙালীরা। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার সহ দেশ এবং জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কাজে সিদ্ধহস্ত তাঁরা। তাই এককথায় বলা যেতে পারে বিদেশের মাটিতে ও তাঁরা বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি করছে।তাই রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী প্রবাসীদের পাসপোর্ট বাতিল করার আবেদন জানাচ্ছি সরকারের কাছে। রোহিঙ্গারা যাতে পাসপোর্ট না পায় সে ব্যাপারে প্রশাসনের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

রোহিঙ্গারা হিংস্রতার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । যে কক্সবাজারবাসী রোহিঙ্গাদের মেহমান হিসেবে ঘরে তুলে সে কক্সবাজারের মানুষের সাথে তারা প্রতিহিংসা মুলুক আচরণ করছে। শরনার্থী হয়ে এসে এই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার চিন্তা করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজস্ব মুদ্রা চালু করে চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে।তারা এদেশে থেকে যাওয়া নিয়ে যতটুকু সরব,নিজেদের দেশে ফেরত নিয়ে ততটুকু নীরব। স্বদেশে ফেরত যাওয়া নিয়ে যার কন্ঠ সবচেয়ে সোচ্চার সে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ কে হত্যা করে তাদের ফিরে না যাবার ইচ্ছা নিয়ে চ্যালেন্জ ছুড়ে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কক্সবাজারের জন্য বিষফোড়া হয়ে দাড়িয়ে আছে । তাদের কারণে উদার রক্ষনশীল সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যাবার পথে। তাই তাদের মেহমান হিসেবে মেনে নেয়া যায় না ।আর মানবিক হওয়া যাচ্ছে না। কক্সবাজারবাসী বাসযোগ্য নিরাপদ জনপদ চায়। কক্সবাজারের স্বার্থ নিয়ে সোচ্চার সামাজিক সংগঠন “আমরা কক্সবাজারবাসী”,রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন মানব বন্ধন, সভা সমাবেশ করে বলেছেন, “রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যকরী ভূমিকা আশা করছে কক্সবাজারবাসী।আর নয় তালবাহানা, শুধু ফেরত যাওয়ার ব্যাবস্থা।

রোহিঙ্গা সমস্যা কক্সবাজারের মানুষের কাঁধের উপরের সমস্যা।কক্সবাজার বাসী আর তাদের ভার বহন করতে অক্ষম। আমরা আর বাহবা চাই না, রোহিঙ্গাদের নিয়ে আর এডওয়ার্ড বা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের দরকার নাই ।নতুন প্রজন্মের বাসযোগ্য নিরাপদ কক্সবাজার চাই।যার সমাধান শুধু মাত্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।

লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্র নেতা।